বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫৬ পূর্বাহ্ন
সঞ্জীব দ্রং:
১. মাতৃভাষার চেয়ে মধুর আর কিছু নেই। ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ যেমন বাঙালিদের কাছে প্রাণের ও আবেগের এবং গভীর মমতা-ভালোবাসার, গারোদের ‘আং আমানি খু’ বা ত্রিপুরাদের ‘আমানি কক’ বা আমার মায়ের আদিবাসী ভাষাও তেমনি আদিবাসী মানুষের কাছে সমান প্রাণের, আবেগের ও গভীর ভালোবাসার। এই কথাটা সবাই যদি সমানভাবে উপলব্ধি করত, সবার মাতৃভাষাকে স্বীকৃতি, সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের সংস্কৃতি যদি দেশে গড়ে উঠত, কত ভালো হতো। নেলসন মেন্ডেলা বলেছিলেন, আপনি যদি একজনের সঙ্গে যে ভাষা সে বোঝে সে ভাষায় কথা বলেন, সেটি তার মস্তিষ্কে যাবে, কিন্তু যদি আপনি তার মাতৃভাষায় কথা বলেন, সেটি তার হৃদয়ে গেঁথে যাবে। মাতৃভাষা যে কী তা অনুভব করা যায় যখন আমরা বিদেশ ভ্রমণ করি। যে জাতির মাতৃভাষা হারিয়ে গেছে, তাদের চেয়ে অভাগা কে আছে? মাতৃভাষা হলো হৃদয়ের স্পন্দন, ছন্দ। দুঃখের বিষয়, সরকারি হিসাবেই বাংলাদেশে ১৪টি মাতৃভাষা প্রায় হারিয়ে গেছে। আরও বিপন্ন কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ আদিবাসী মাতৃভাষা। সঠিক ও যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এই ভাষাগুলোও চিরতরে হারিয়ে যাবে পৃথিবীর বুক থেকে। আমরা অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, ভবন, ব্রিজ আর দালানকোঠা বিরামহীন নির্মাণ করছি, হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিচ্ছি আর কত কত মেগা প্রকল্প চলমান। কিন্তু মানুষের
সংস্কৃতি, চিন্তা, সৌজন্যবোধ, শিল্প, সাহিত্য, কাব্যবোধ সৃষ্টির চেষ্টা, মেধা ও জ্ঞানের কী করুণ দশা এখানে। একদিকে ‘অপ্রতিরোধ্য’ উন্নয়ন, অন্যদিকে ব্যাপক বৈষম্য ও দুর্নীতির অনিয়মতন্ত্র চলছে।
২. আমাদের একটি বড় সুযোগ চলে গেল গত বছর। জাতিসংঘ ২০১৯ সালকে ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অব ইনডিজিনাস ল্যাংগুয়েজ বা আন্তর্জাতিক আদিবাসী মাতৃভাষা বর্ষ ঘোষণা করেছিল। আমাদের সুযোগ ছিল সারা বছর ধরে আদিবাসী ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার এবং এই ভাষাগুলো যাতে বিকশিত হতে পারে, তার জন্য কাজ করার। কিন্তু সেই কাজটি আমরা করিনি। অবহেলা করেছি। আদিবাসীরা নিজেরা শুধু তাদের মাতৃভাষা রক্ষার জন্য সচেতন হলে তো হবে না। অন্যরাও বিশেষ করে বৃহত্তর মূলধারার সমাজ যাতে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য এগিয়ে আসে, এই আহ্বান জানানো হয়েছিল এই বছরে। সদস্য রাষ্ট্রে কর্তব্য ছিল কাজটি করা। এই ঘোষণায় জাতিসংঘ আরও বলেছিল যে, ভাষা শুধু শিক্ষা, উন্নয়ন, সামাজিক উন্নতির মাধ্যম নয়, প্রত্যেক ব্যক্তির স্বতন্ত্র পরিচিতি, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মেমোরির জন্য মাতৃভাষা গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের তথ্য মতে, বিশ্বের মোট ৬,৭০০ ভাষার মধ্যে ৯৬% ভাষায় কথা বলে মাত্র ৩% মানুষ। এই পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা যায়, বিশ্বে ইংরেজিসহ প্রভাবশালী ভাষার চাপে সংখ্যালঘু মানুষের ভাষা সত্যি বিপন্ন।
ইউনেস্কোর মতে, পৃথিবী থেকে প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে মাতৃভাষা তার সমগ্র সংস্কৃতি, জ্ঞান, গল্পকথা ও ঐতিহ্যসহ হারিয়ে যাচ্ছে। ইউনেস্কো আরও বলছে, ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, ভাষা আমাদের মানব সভ্যতার নির্দেশক। আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের বিশ্বাস, আমাদের পরিচয় ও অস্তিত্ব এই ভাষার সঙ্গে যুক্ত। ভাষার মাধ্যমে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জ্ঞান বিনিময় করি। ভাষার বৈচিত্র্য আমাদের কল্পনাশক্তি ও জীবনধারাকে সমৃদ্ধ করে।
ইউনেস্কো বলছে, পৃথিবীর ৬,৭০০ ভাষার মধ্যে অধিকাংশ ভাষা হলো আদিবাসীদের যার সংখ্যা প্রায় ৫,০০০। আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে এই ভাষাগুলোর ৯৫% এই শতাব্দীর মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই জন্য ইউনেস্কো জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দ্রুত এই ভাষাগুলোকে রক্ষা করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে তাগিদ দিয়েছে। এমনকি ইউনেস্কো ‘আমাদের ভাষা, আমাদের সম্পদ’ নামে প্রচারণাও চালিয়েছে। ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে, তখন এই ঘোষণার মূল বক্তব্যই ছিল ভাষার বহুত্ব এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ভিন্নতাকে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা। সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে এ জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে ইউনেস্কার ঘোষণায়।
৩. বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে একটি নৃভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। আমিও এই সমীক্ষা কাজে একটি কমিটির সদস্য। এই সমীক্ষার চূড়ান্ত রিপোর্ট এখনো হয়নি। সমীক্ষায় পাওয়া গেছে বাংলাদেশে ৪১টি ভাষায় মানুষ কথা বলে। বাংলা ও উর্দু বাদে ৩৯টি ভাষা হলো আদিবাসীদের। সমীক্ষায় ১৪টি ভাষাকে আন্তর্জাতিক মানদ- অনুসারে বাংলাদেশের বিপন্ন ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো খাড়িয়া, কড়া, সৌরা, মু-ারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও পাত্র। কিন্তু আমি মনে করি বাগদী, তেলী, ভূমিজ, গঞ্জু, মুসহর, হাজং, বানাই, কোচ, ডালু, লোহার, রাজুয়াড়, তুরি, শবর, ভীল, হো, বম, বর্মন, মালো, মাহাতো, কন্দসহ আরও অনেকের ভাষাই এখানে বিপন্ন। কিছু কিছু জাতির ভাষা হারিয়ে গেছে অথচ এ বিষয়ে আমাদের এখানে তেমন গবেষণা হয়নি।
মাতৃভাষার মর্যাদার বিষয়ে সর্বজনীন ভাষা অধিকার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা শেখার অধিকার রয়েছে। শুধু তাই নয়, ১৯৯৬ সালের এই ঘোষণাপত্রে বলা আছে, সব ভাষাভিত্তিক জনগোষ্ঠীর আইনগত অধিকার সমান। এছাড়াও জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের মাতৃভাষার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। আমাদের বড় দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরেও আদিবাসী ভাষা, সংস্কৃতি, উন্নয়ন ও অধিকারের প্রশ্নে রাষ্ট্রের কোনো নীতিমালা নেই। আমার অনুরোধ থাকবে, সরকার যেন অবিলম্বে একটি জাতীয় আদিবাসী ভাষা অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করে যেখানে পরিচালনাসহ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আদিবাসীদের অংশীদারত্ব থাকবে।
৪. আমরা বহুবার বলেছি, বাংলাদেশ বহু জাতির, বহু ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির মানুষের বৈচিত্র্যময় সমৃদ্ধ দেশ। এই বৈচিত্র্যই আমাদের শক্তি ও সৌন্দর্য। এ কথাটি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতিকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। সরকার শিক্ষানীতি অনুযায়ী ৬টি আদিবাসী ভাষায় প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশোনার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। হরফ নিয়ে জটিলতার কারণে সাঁওতালি ভাষায় বই প্রকাশের কাজ থেমে আছে। তবে বাকি ৫টি ভাষায় অর্থাৎ গারো, সাদ্রি (উঁরাও), চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ভাষায় বই প্রকাশ করা হলেও এখনো পাঠদান প্রকৃত অর্থে শুরুই হয়নি। কেননা নতুন কোনো শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি, প্রশিক্ষণ বা নীতিমালা প্রণীত হয়নি। স্কুল সময়ে কখন এই ভাষায় পাঠদান হবে, কিছুই ঠিক হয়নি। তারপরও এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। এখন দ্রুত বাকি কাজগুলো করা দরকার। বিশেষ করে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ করা দরকার। স্পেশাল নিয়োগের কথা আমি অনেকবার বলেছি। বলতে বলতে সংশ্লিষ্টদের কুম্ভকর্ণের ভাব দেখে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সংখ্যায় যত ক্ষুদ্রই হোক, পৃথিবী থেকে কোনো ভাষাকে বিলুপ্ত হতে দেওয়া যাবে না। কেননা ভাষা হারিয়ে গেলে অনুভূতি হারিয়ে যায়, আবেগ ও মূল্যবোধ হারিয়ে যায়। পৃথিবী থেকে কোনো ভাষা হারিয়ে যাওয়া মানে জ্ঞান হারিয়ে যাওয়া, প্রাচীন সভ্যতা হারিয়ে যাওয়া। যে ভাষা হারিয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে তার গল্প, তার জ্ঞান, সাহিত্য,সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, সংগীত, পুরো একটি সভ্যতা হারিয়ে যায়।
৫. আমরা বহুদিন ধরে আদিবাসীদের সঙ্গে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের সংস্কৃতির আদান-প্রদান ও জানাজানির গুরুত্বের কথা বলে আসছি। আদিবাসীদের রয়েছে সমৃদ্ধ প্রাচীন সংস্কৃতি, উন্নত সভ্যতা ও প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া চিরায়ত জ্ঞান। এসব আদিবাসী জ্ঞান বা ইনডিজিনাস নলেজ এখন জাতিসংঘসহ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হচ্ছে। প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, বন ও পরিবেশ রক্ষায় আদিবাসীদের অবদান অনেক। বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের ৮০% আদিবাসীরা সংরক্ষণ করে। তাই ভাষা হারিয়ে গেলে জ্ঞানভা-ার নিয়ে সবই হারিয়ে যাবে। তাই এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে কোনো ভাষাই হারিয়ে না যায়। এজন্য জাতিসংঘসহ তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। ইউনেস্কো আমাদের দেশে কাজ করতে পারে। বেসরকারি উদ্যোগ এবং আদিবাসী সংগঠনগুলোর করণীয় রয়েছে এখানে। আমি অনেক শিক্ষিত আদিবাসী পরিবারকে শহরে দেখি যারা সন্তানদের মাতৃভাষা থেকে বঞ্চিত করেন। ফলে সন্তানরা আদিবাসী ভাষা বলতে পারে না। অনেকে মনে করেন শিশুকাল থেকে বাংলা শিখলে পড়াশোনায় ভালো করা যায়। আমার অভিজ্ঞতা এমন নয়। বরং শিশুরা একসঙ্গে অনেক ভাষা দ্রুত রপ্ত করতে পারে। ভাষা নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের অভিজ্ঞতাও এমনি। আদিবাসী শিশুরা নিশ্চয় বাংলা, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষাও শিখবে। কিন্তু অবশ্যই নিজের মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। তরুণদের মধ্যে আদিবাসী ভাষায় গান, কবিতা, গল্প, অন্যান্য রচনা উৎসাহিত করা প্রয়োজন। জাতিসংঘ ৫টি কাজের ওপর জোর দিয়েছে। যেমন ১. আদিবাসী ভাষার প্রতি ব্যাপক জ্ঞানার্জন ও জানাজানির ব্যবস্থা করা, সংগ্রহ ও সমন্বয় এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা, ২. জ্ঞান সহভাগিতার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি, ৩. আদিবাসী ভাষাগুলোর মান নিরূপণ, ৪. দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভাষার সক্ষমতা, ৫. প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য নতুন নতুন জ্ঞান সাধন। আমরা আশা করব আমাদের দেশেও আদিবাসী ভাষা নিয়ে ব্যাপক কার্যক্রম সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শুরু হবে। আমরা নিজেরাও কাজ করব। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের মায়া-মমতা বাড়বে।
যার মায়ের ভাষা হারিয়ে যায়, তার চেয়ে হতভাগ্য দুঃখী মানুষ এই পৃথিবীতে আর কে হতে পারে? লতা মুঙ্গেশকর গেয়েছিলেন, ‘কেন কিছু কথা বলো না/না বলে যা যাও বলে/ ভাষাহীনা ভাষার বেদনা!/ কেন কিছু কথা বলো না।’ গানটি শুনলে বুকটা হাহাকার করে ওঠে। এই গানের কথা যেমন, সুর আরও করুণ। মন কেমন যেন উদাসী হয়ে যায়, শূন্যতায়। আসুন আজ সবাই ভাষাহীনা মানুষের বেদনা অনুভব করার চেষ্টা করি আর ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিই।
লেখক কলামনিস্ট ও মানবাধিকারকর্মী
sanjeebdrong@gmail.com